খায়রুল স্যার
আমরা যারা খুলনা জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলাম তারা খায়রুল স্যারকে কম-বেশী সবাই চিনি। বিশেষ করে KZS-14 ব্যাচ স্কুল জীবনের যে ক'জন স্যারকে আজীবন ভুলতে পারব না তাঁদের ভেতর খায়রুল স্যার অন্যতম। স্কুলে আর কোনো স্যার হয়ত খায়রুল স্যারের মত নিয়ম করে ক্লাসে সিলেবাস শেষ করাতেন না আর হোমওয়ার্কের জন্য এতো প্যারাদিতেন না। আর স্কুলে প্রত্যেক গ্রুপে যারা বাসা থেকে লুকিয়ে ব্যাট-বল আনার দায়িত্বে থাকত, তাদের কাছে এক জমের নাম খায়রুল স্যার। আমার সেই গ্রিপ ছাড়া মিনি ব্যাটটা! ইস!! একদিন অন্টিকে সাত-আট ঘা বেতেরবাড়ি দিয়ে ব্যাটটাকে কয়েদ করেছিলেন স্যার। সেদিন আমরা যেই ছ্যাকাটা খাইসিলাম সেই শোকে টিফিনটাইমে ১সপ্তাহ লালভবনের পিছের মাটির ঢিবিতে জবুথুবু হয়ে বেকার বসে কাটাইসি। কখনও ভুলব না স্যারের শাসনগুলা৷
আমি শেষ স্যারের দেখা পেয়েছিলাম খুব সম্ভবত ক্লাস এইটে, জিলা স্কুল কোয়ার্টারে। "এইটা কোনটা? ওহ রে বন্দর! (স্যার বাঁদরকে আজীবন এই নামে অভিহিত করে এসেছেন) ভরদুপুরে ব্যাটপিটানো হচ্ছে! আমি আসার আগে সব ক'টারে নিয়ে ভাগ। নাইলে আমি এসে তোরে ব্যাট দিয়ে পিটাবো।"
এরপর আর স্যারের দেখা পাই নাই। পরে শুনেছিলাম উনি বদলি হয়ে গেছেন। সেদিন সন্ধ্যায় যখন টিউশন দিতে স্টুডেন্ট এর বাসায় ঢুকছি গেটের ভেতর থেকে একটা পরিচিত কন্ঠস্বর আর সেই চিরচেনা একসেন্ট, "এই! এইটা কোনটা! ওরে বাপ! বন্দরের আবার চোখ খারাপ হইসে! চশমা লাগতিসে আজকাল!"
আমি কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাড়িয়ে গেলাম। দেখলাম আমাদের খায়রুল স্যার আর তাঁর সেই ফনিক্স সাইকেল। স্যারকে কদমবুচি করে জিজ্ঞাসা করলাম কেমন আছেন। উত্তরে স্যার বললেন, "আমি তো দিব্যি আছি, তুই সুস্থ তো এখন পুরোপুরি? চেক-আপে যাস তো ঠিকঠাক??" ড্যাবড্যাব করে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। মানে স্যার আমাকেই শুধু মনে রাখননি, আমার ট্রাজেডির কথাও মনে রাখসেন!! শুধু আমার না, স্যার আমাদের ক্লাসের আরও মানুষের খোঁজখবর নিলেন। হিমাদ্রী, অনিম, প্রত্যয়, অনিরুদ্ধ(অন্টি), রাতুল, কাব্য কাউকেই স্যার ভোলেননি। অনেক ইচ্ছা করতেসিলো স্যারের সাথে একটা সেলফি তুলি। কিন্তু হাতটা পেছনে নিয়ে একটু কুঁজো হয়ে স্যারের কথা শুনে গেলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল, ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছিল। আজন্ম লালিত এ কৈশোরস্মৃতি, আজন্ম লালিত এ ভালোবাসা, আজন্ম লালিত এ আবেগ। স্যার সাইকেল নিয়ে রওয়ানা দেবার পর গেটের ওখানেই দাঁড়িয়ে কাঁদছি। "...ভাইয়া ভেতরে আসবেন না?" স্টুডেন্ট এর ডাকে সম্বিত ফিরল।